বাংলাদেশে সুন্দরী হিজড়াদের অসুন্দর জীবন: বিড়ম্বনার শেষ কোথায়?


হিজড়াদেরকে 'বিরক্তি' বা 'আতঙ্ক' হিসেবে দেখেন না এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। বিশেষত, ঢাকায় তো কথাই নেই। সাধারণ মানুষের চলাচলের জায়গা যেমন - পার্ক, রাস্তা ও গণপরিবহণে রয়েছে হিজড়াদের সরব উপস্থিতি। মুখের সামনে অতর্কিতে হাত বাড়িয়ে অথবা গায়ের উপরে প্রায় পড়ি-পড়ি হয়ে তারা টাকার আবদার ধরেন। নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণীকে একত্রে পেলেই তাদেরকে হিজড়ারা স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা ভেবে  রসালো মন্তব্য ছোঁড়েন এবং জবরদস্তিমূলক টাকা আদায় করেন। আর টাকা না দিলে অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় চেঁচামেচির ঘটনাও নিত্য ঘটছে। টাকা না দিলে, এমনকি কখনো-কখনো পুরুষের স্পর্শকাতর অঙ্গের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। চাঁদাবাজি নিয়ে হিজড়াদের হাতে নাজেহাল হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমেও বিভিন্ন সময়ে এসেছে। অতএব হিজড়ারা যে এ শহরে বা আরো বৃহদ ভাবে বললে, আমাদের এই সমাজে একটা বিড়ম্বনার নাম তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু কেন হিজড়ারা এমন জীবন বেছে নেন? সেটি কি কখনো ভেবেছেন? পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সবখানে তারা কেবল অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার। সম্মানজনক কোনো একটি কাজ করে জীবন কাটানোর মতন একটি সামাজিক বাস্তবতা কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি?
আমরা কি এই সমাজে নিশ্চিত করতে পেরেছি হিজড়াদের সমানাধিকার? হিজড়া পরিচয়ে কোনো শিশু কি আজো স্কুলে যেতে পারবে? কোনো পরিবার কি আজো তার সন্তানকে হিজড়া হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে?

না, পারবে না, দেবে না, দেয় না। এই যে লোকলজ্জার সংস্কৃতি এটি নিয়ে ভাবতে হবে। নিন্দা আর লজ্জা জারি রাখার সমাজ না পাল্টালে একটি হিজড়া কিশোর ভয়-লজ্জা ও হীনমন্যতা নিয়ে বড় হবে। নিজেকে ছেলে বা মেয়ে বলে সমাজে একটা ছদ্ম পরিচয় দিয়ে সে যখন বেড়ে উঠবে তখন তার মনের মধ্যে জমা হবে ক্লেদ, দুঃখ ও বঞ্চনা। ফলে, সে কিছুতেই নিজেকে মূল জনস্রোতের অংশ মনে করবে না। লোকলজ্জার ভয়ে একটা সময়ে পরিবারও হিজড়া সন্তানকে 'দায়' মনে করে। অতএব পরিবার থেকে পালিয়েই যেনো মুক্তি। নির্ভার হয়ে বাঁচতে হিজড়ারা খুঁজে নেয় আলাদা সমাজ। নেয় গুরু মায়ের কাছে দীক্ষা। রপ্ত করতে থাকে হাতে তালি বাজিয়ে, কোমর দুলিয়ে, মুখে কড়া মেক আপ মেখে নাচা-গানের তালিম। অর্থাৎ, বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই হিজড়ারা নামেন যৌনকর্ম ও চাঁদাবাজির পেশায়।

কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলায় পিংকি নামের এক হিজড়া প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পরেশনে কাজ করছে একাধিক হিজড়া। ঢাকায় শাম্মী নামে একজন হিজড়া পার্লারের ব্যবসা দিয়ে বেছে নিয়েছেন সম্মানের জীবন। তিনি ভালো আয়-রোজগারও করেছেন। শাম্মী নিজেই জানিয়েছেন, তার পার্লারে নারীরা আসতে সংকোচ বোধ করছেন না। বরং তৈরি হয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবেশ। এরকম অনেকেই এখন নিজেদের পায়ে দাড়ানোর চেষ্টায় করছেন। বাংলাদেশে মোট ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে হিজড়ার সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার। হিজড়াদেরকে বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু হিজড়াদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বদল হয়নি। এই সমাজে তারা অচ্ছুৎ। তাদের কাগুজে কিছু অধিকার আছে বটে। কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় তারা অবহেলিত। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সম্মিলিত অনুদারতাই তাদেরকে অভিশপ্ত করে রেখেছে। 

হিজড়াদের জীবনেও আছে নানা কষ্ট, আছে সমাজের মানুষগুলোর ধিক্কারের চাপা কষ্ট। অবহেলা আর তাচ্ছিল্যে ভরা জীবনের কালো অধ্যায়। 

এমনই একজন সভা। তবে আসল নাম শুভ। ছেলে হয়ে জন্ম নিলেও এখন সে হিজড়া। থাকতে পারেন না পরিবার বা সমাজের আর স্বাভাবিক মানুষগুলোর সাথে। তাচ্ছিল্য আর অবহেলায় এখন আশ্রয় নিয়েছেন ঢাকার অন্য হিজড়াদের সাথে। সোভা বলেন, আমি হিজড়া এটা কি আমার দোষ? আমিও তো আর দশজন মানুষের মত মানুষ। আমার গায়ে তো হিজড়া লেখা নেই। আমি ছোটবেলা থেকেই সবকিছু থেকে বঞ্চিত। সমাজের মানুষেরা হিজড়া দেখলেই নাক সিটকায়। অবজ্ঞার চোখে দেখে। সমাজের মানুষ ধিক্কার দেয়। আমরা কোথাও কাজ করতে গেলেও করতে পারি না। হিজড়া জানতে পেরে কাজ থেকে বের করে দেয়। আল্লাহ প্রদত্ত আমি এমন। আমার কাজে কোনো সমস্যা না থাকাতেও হিজড়া বলে কাজে রাখেনি। বলে, হিজড়াদের কাজে রাখা যাবে না।

পশ্চিমা দুনিয়ায় আজকাল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারী বা পুরুষ লিঙ্গ বদল করে তার পছন্দের লৈঙ্গিক-জীবন বেছে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে ডেনমার্কেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
এইনার ওয়েগনার নামের এক তরুণ নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করেন। সেই ভাবনার তীব্রতা এতই প্রবল ছিল যে, 'জেন্ডার রিএসাইনমেন্ট' বা লিঙ্গ বদলের জন্য তিনি অপারেশান করিয়েছিলেন। লিলি এলবে নামে তিনি পরিচিত এবং ট্রান্সজেন্ডারের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

তবে ইসলাম এগুলো সমর্থন করে না। ইসলাম হিজড়াদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ মনে করে। ইসলাম বলছে, বিশ্বজগৎ একমাত্র আল্লাহ তাআলারই খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলছে। ‘আল্লাহ, তিনি যা ইচ্ছা, যেমন করে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। [পবিত্র কোরআন—সুরা : শুরা, আয়াত : ৪৯]।

একজনকে লিঙ্গ দেননি, আবার আরেকজনকে দিয়েছেন। এ দুনিয়ার সামান্য থেকে সামান্য, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র, কিছুর সৃষ্টিই মহান আল্লাহর হেকমতের বাইরে নয়। আল্লাহ তাআলার কাছেও তাই বাহ্যিক আকার-আকৃতির কোনো মূল্য নেই। কারণ এ আকৃতি তার নিজের ইচ্ছায়ই হয়েছে, মানুষের এতে কোনো হাত নেই। হাশরের ময়দানে তিনি দেখবেন শুধু মানুষের আমল। [মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ৬৭০৮]

আমাদের এমন একটা সমাজ চাই যে সমাজ লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে কাউকে অচ্ছুৎ করে রাখবে না। যে সমাজ হিজড়াদেরকেও নারী ও পুরুষের মতনই সমান মর্যাদায় বুকে টেনে নেবে। শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, হিজড়াদেরও চাই কর্মে যুক্ত হবার মনোবৃত্তি। পাকিস্তানের মতন কট্টর দেশে বৃহন্নলা সংবাদ পাঠক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মডেল কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রতিবেশী ভারতে একজন কিন্নর এমনকি জনপ্রতিনিধি হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ নিজের যদি খেটে খাবার মানসিকতা থাকে তাহলে হিজড়াদের পক্ষেও সম্মানজনক জীবিকা বেছে নেয়া সম্ভব। হয়তো শুরুতে পথচলাটা কঠিন হবে। কিন্তু বাধা যে অতিক্রম করা সম্ভব শাম্মী হিজড়াই তা করে দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশে হিজড়াদের যে সব সংগঠন আছে সেগুলোর জোরালো ভূমিকা দরকার। কী করে যৌনপেশা ও চাঁদাবাজি থেকে বেরিয়ে এসে সম্মানজনক বৃত্তি বেছে নেয়া যায় সেই দিকে তাদের এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশেও হয়তো একদিন অনেক হিজড়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়বে। পাবেন প্রার্থিত জীবন। কিন্তু তার আগে মানুষের ইচ্ছেকে আমাদের সম্মান জানাতে পারার সংস্কৃতি প্রয়োজন। এরাও তো মানুষ। এদের জন্যও আমাদের সহানভুতি থাকা উচিত। প্রয়োজন একটি উদার সমাজ নির্মাণ। যেখানে লিঙ্গ-বৈষম্যের শিকার হবে না নারী বা পুরুষ বা হিজড়া। যেখানে লিঙ্গ-পরিচয় ব্যতিরেকেই একজন মানুষ পাবেন সুযোগ ও সম্মান।  

বন্ধুরা, এ বিষয়ে আপনি কিছু বলতে চাইলে বা জানাতে চাইলে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই আপনার মন্তব্য করুন। ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন আর সত্য, রোমাঞ্চকর ও ভিন্নধর্মী খবর পেতে সবার আগে পেতে অবশ্যই আমাদের চ্যনেটিকে সাবস্ক্রাইব করুন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Comments