পদ্মার নির্মল হাওয়া দ্বারে এসে আছড়ে পড়ছে। তাতে আবার বসন্তের গন্ধ। এ পাড়ায় কারও কারও ভোর হয় বেশ আগেই। আগের দিন দোল উৎসব ছিল। পাড়ার অনেকেই মেতেছিল রং মেলান্তি খেলায়। গোসল সেরে রাঙা প্রভাতেই পাড়ার গলিপথ দখলে নিয়েছে ওরা।
ভোরের আভা নিভে সূর্যের কিরণ তীর্যক রূপ নিতেই খুপড়ি ঘরগুলোর দ্বার উদাম হচ্ছে। ততোক্ষণে পাড়ার গলিগুলোতে যেন পরীর মেলা বসেছে। হাঁসি, তামাশা, খুঁনসুটি চলছে হরদম। আবার অশালীন, অস্রাব্য ভাষায় খিস্তিও (গালমন্দ) কাটছে কেউ কেউ। গেল রজনীতে ঘরে থাকা বাবুদের (খদ্দের) নানা কথাও। কোন বাবু কত বকশিশ দিল, কোন বাবুর বউ কেমন এমনই আলাপে ওরা একেবারে জমিয়ে তুলছে।
সময় গড়িয়ে সকাল ৮টা তখন। কয়েকজন মধ্যবয়সী থাকলেও অপেক্ষকৃত তরুণীদের দখলেই পুরুষের এই রংমহল। মধ্য বয়সীরা বেশির ভাগই প্রিন্টের সূতি শাড়ি আর স্বল্প আকৃতির ব্লাউজ পরা। কম বয়সীদের বসন বেশির ভাগ-ই সেলোওয়ার-কামিজ। গেঞ্জি, প্যান্ট, শর্ট স্কার্টও আছে কারও কারও পরনে।
সাজ বেলায় যে ওরা উদাসীন নয়, তা প্রত্যেকের রূপেই প্রকাশ। রংচটা মেকআপ বদন জুড়ে। বসনের সঙ্গে মিলিয়ে লিপিস্টিক। লিপিস্টিকের রংয়ে মিলিয়ে কপালে ছোট-বড় টিপ। কড়া পারফিউম, যেন নিশিকালে কামিনী ফুলের সুভাস বইছে। অঙ্গ সাজের কোনোই ঘাটতি নেই ওদের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয়োজনের কমতি নেই দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীতে। তবে, এত আয়োজনের মধ্যেও ভালো নেই তারা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। পাশের রাজপথ থেকে পুরুষের আনাগোনা বাড়ছে। আর ঠিক এটাই হলো দৌলতদিয়ার যৌনপল্লী। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বড় পতিতালয় দৌলতদিয়া। যেখানে আমাদের দেশে পতিতাবৃত্তি আড়াল করে রাখা হয় ছোটখাটো একটা শহরের সমান এই যাইগার পতিতাবৃত্তিকে লুকিয়ে রাখাই দায়। রাজধানী ঢাকার প্রায় ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে দৌলতদিয়া অবস্থিত। গত ৩০ বছর ধরেই এশিয়ার সবথেকে বড় পতিতালয়গুলোর মধ্যে দৌলতদিয়া একটি। ইসলামিক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের এইরকম এত পতিতাবৃত্তি সহ্য করা হয়। সাড়ে ৪ হাজার এর বেশী যৌনকর্মী এখানে দিন রাত কাজ করে। অনেকের জন্মও এখানে। অন্যরা আশেপাশের অনেক যায়গা থেকেই আসে।
প্রায় ১ মাস আগে রিমি ঢাকায় থাকতো। তার বাবা আর কর্মক্ষম ছিলো না। তার এক পরিচিত ব্যাক্তি তাকে কাজের লোভ দেখিয়ে এখানে পাচার করে দেয়। ১ মাস আগে সে কুমারী ছিলো। কিন্তু এখন তার ৪০ জন ক্লায়েন্ট। আর কোন উপায় না দেখে সে এখানে মানিয়ে নেয়। তার কাস্টমার ছাড়া তার সাথে এখন আর কেউ দেখা করতে আসে না। এখন তার এই ছোট্ট ঘরই তার কাছে সব। আর এরকম ভাবেই এই ছোট্ট শহরের অর্থনীতি সচল আছে।
দৌলতদিয়া ঘাটে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক পার হয়। যার মধ্যে থাকে প্রায় হাজার ২ ট্রাক, বাস আরো এরকম অনেক গাড়ি। আর এই পল্লীর সব থেকে বেশী কাস্টমার আসে এখান থেকেই। কাস্টমারদের বেশিরভাগই ট্রাকের ড্রাইভার, হেল্পার। এই পতিতালয় সারা বছরি খোলা থাকে। এদের নাই কোন ছুটি নাই কোন অবসর।
শাহিন আর স্বপন এখানেই থাকে। তাদের মা আগে পতিতাবৃতি করতো। তাদের বাবা ছিলো একজন কাস্টমার। এক গলির একেবারে শেষ মাথায় তাদের বসবাস। তাদের মা মমতার বয়স ৩৭। তার ৬ ছেলে মেয়ে। সবচেয়ে বড় মেয়ের না খুশি যে এখানে এখন পতিতাবৃত্তিরি কাজ করে। সেই বর্তমানে পরিবারের আয়ের উৎস। প্রতিমাসে তার আয় ১৫ হাজার টাকা যা অর্ধেকই যায় ৩ রুমের ভাড়াতে। তারপরেও তাদের পরিবার এই বিজনেস থেকে সরে যেতে পারেনি। ১৩ বছর বয়স থেকে খুশি এই কাজ করে আসছে।
শাহীন আর স্বপন পাশের একটা স্কুলে পড়াশোনা করে। স্কুলটি এই ছোট্ট শহরের বাচ্চাদের জন্যেই বানানো। এখানকার একজন শিক্ষিকা জাহানারা। তিনিও আগে পতিতাবৃতির সাথেই জড়িত ছিলেন কিন্তু এখন ওই কাজ থেকে সরে এসে বাচ্ছাদের দেখাশোনা করছেন।
চায়ের দোকানের বসে পল্লীর নানা বিষয়ে আলাপ হয় রিতা নামের এক কর্মীর সঙ্গে। চল্লিশের ঘরে পা রেখেছেন রিতা। ১৯ বছর বয়সি মেয়ে পিংকিকে বাসে তুলে দিয়ে এসে চা-সিগারেট খেতেই বসলেন এখানে। তিনি তার মেয়েকে ঢাকায় পাঠালেন। এখন ঢাকার হোটেলে কাজ করলেই নাকি ভালো বকশিশ পাওয়া যায়।
আলাপের মধ্যখানে যোগ দেন নিশা নামের আরেক যৌনকর্মী। ৯ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পাচার হয়ে আসা নিশার ঠিকানা মিলেছে দৌলতদিয়া ঘাটের এ পল্লীতে। এখানেই তিন সরদারনীর হাত ঘুরে বিক্রি হয়েছেন তিন বার। এখন নিজেই ঘর ভাড়া নিয়ে কাজ করেন।
পাশে একটা রুমে থাকে কালী। তার বয়স ৩১। ১৫ বছর বয়স থেকেই সে এই পেশায় যুক্ত। প্রথম দিকে সে অনেক রুগ্ন ছিলো। কাস্টমাররা তার দিকে ঠিক করে তাকাতো না। তারপর সে অন্যদের পরামর্শে অরাডেক্সন নামে মোটা হওয়ার ওষুধ খাওয়া শুরু করেন। আসলে এই ওষুধটা গবাদী পশুর সাস্থ্য বৃদ্ধির জন্যে তৈরী করা কিন্তু এখানে প্রতিটা ফার্মেসীতেই এই ওষুধ প্রেস্ক্রিপশন বাদেই কেনা যায়। যার প্রতিক্রিয়া মানুষের জন্যে অনেক ভয়াবহ। এখানে এইডস বা এস. টি. ডি চেকাপেরও কোন ব্যবস্থা নেয়। এখানে মেয়েদের বেচে থাকার গড় বয়স অনেক কম। এই অসহনীয় অবস্থা সহ্য করতে পা পেরে শিল্পী নামের এক মহিলা কয়েকদিন আগেই আত্মহত্যা করেছেন। এই পল্লীতে জন্ম যেমন নিত্যনৈমত্তিক ব্যপার তেমন মৃত্যুও। প্রতিদিনের মাদক, অসুস্থ যৌনতা, মারামারি আর জন্ম মৃত্যু দিয়েই যেনো রচিত হয়েছে দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীদের গল্প।
বাংলাদেশে এখন রেজিস্টার্ড যৌনপল্লির সংখ্যা ১০টি৷ গত দুই দশকে বেশ কিছু যৌনপল্লি উচ্ছেদ হয়েছে৷ নারায়লগঞ্জের টানবাজার এবং ঢাকার ইংলিশ রোডের যৌনপল্লিও এক রাতের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছিল৷ এই দু'টি যৌনপল্লির যৌনকর্মীদেরও মারপিট ও নির্যাতন করে উচ্ছেদ করা হয়৷ প্রভাবশালীরা প্রশাসনের সহায়তায় এ কাজ করে৷ যৌনকর্মীদের আটক করে ‘প্রিজন ভ্যানে' ভবঘুরে কেন্দ্রে পঠানো হলেও, তাঁরা শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকেননি৷ তাঁদের অনেকেই এখন ভাসমান যৌনকর্মী৷ বাংলাদেশে ‘পতিতাবৃত্তি' অবৈধ নয়৷ প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যাঁদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি, তাঁরা স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে এই পেশা বেছে নিতে পারেন৷ তবে রাষ্ট্র পতিতাবৃত্তি বন্ধে ব্যবস্থা নেবে৷ এখানে জোর করে কাউকে এই পেশায় নিয়োজিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তাছাড়া ১৮ বছরের নীচে কোনো নারী এই পেশা বেছে নিতে পারবেন না৷ তবে এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিতেও পুলিশকে ঘুস দিতে হয়৷ ২০ হাজার টাকার কমে অনুমতি মেলে না৷
সব মিলিয়ে ভাল নেই দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীরা, আমাদের দেশের যৌনকর্মীরা।
বন্ধুরা, এ বিষয়ে আপনি কিছু বলতে চাইলে বা জানাতে চাইলে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই আপনার মন্তব্য করুন। ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন আর সত্য, রোমাঞ্চকর ও ভিন্নধর্মী খবর পেতে সবার আগে পেতে অবশ্যই আমাদের চ্যনেটিকে সাবস্ক্রাইব করুন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment